সোমবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৪। ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় ভোর থেকে বইছে হিমশীতল আবহাওয়া। এর মাঝেই সকাল ১০টায় হেলিকপ্টারে করে সেখানে ছুটে গেলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার গন্তব্য বহুল আলোচিত রাম মন্দিরে।
ঘড়ির কাটায় তখন দুপুর ১২টা। মোদির গন্তব্য চাপিয়ে পুরো ভারতের চোখ রাম মন্দিরে। সেখানে তখন চলছে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। আর এই আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদ্বোধন হলো রাম মন্দিরের। নরেন্দ্র মোদি এর উদ্বোধন করেন। তারপর দুপুর সোয়া ১টার দিকে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
![](https://jamuna.tv/wp-content/uploads/2024/01/image-144.png)
এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের নাম দেয়া হয়েছিল ‘রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা’। তাতে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, পন্ডিতবর্গসহ ৭ হাজার অতিথি অংশ নিয়েছিলেন। অতিথির তালিকায় ছিলেন দেশটির রাজনীতিবিদ, তারকা, ব্যবসায়ীরাও। এই আয়োজনকে ঘিরে দেশটিতে বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ।
![](https://jamuna.tv/wp-content/uploads/2024/01/image-145.png)
উৎসবের পাশাপাশি এই মন্দিরের উদ্বোধন ঘিরে ভারতের অনেক বাসিন্দার মধ্যে রয়েছে কষ্ট-ক্ষোভ। বিশেষ করে স্থানীয় মুসলিমদের মধ্যে। এছাড়া, অনুষ্ঠানে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও তারা যাননি। যার মধ্যে রয়েছেন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা, শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে, সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব, তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরিও। তাদের অভিযোগ, মন্দিরের নামে ভোট সংগ্রহের চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন বিজেপি।
কেন আলোচনায় রাম মন্দির:
মন্দিরটি যেখানে তৈরি হয়েছে, সেটা ভারতের সবচেয়ে বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানগুলোর অন্যতম। সেখানেই একসময় ছিল বাবরি মসজিদ। যা ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি করা হয়। রাম মন্দির ধ্বংস করে ওই মসজিদ গড়া হয়েছিল দাবি তোলে উন্মত্ত হিন্দু জনতা ১৯৯২ সালে মসজিদটি ভেঙে দেয়। তারপরে সারাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। তাতে মারা যান প্রায় দুই হাজার মানুষ। যার বেশিরভাগ সংখ্যালঘু মুসলমান।
![](https://jamuna.tv/wp-content/uploads/2024/01/image-141-1024x576.png)
মসজিদটি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল, ঠিক সেই জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে রাম মন্দির। ২০১৯ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অযোদ্ধায় হিন্দুদের মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেয়। দীর্ঘদিনের এক মামলার আইনি লড়াই শেষে আদালত ওই স্থানে মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেয়ার পাশাপাশি একই শহরের আরেকটি এলাকায় মুসলমানদের মসজিদ নির্মাণের জন্য জায়গা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে মসজিদের উপর হামলা ঘটেছিল ঠিক সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে এই মন্দিরটি!
২০১৯ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক আদেশে ওই বিতর্কিত স্থানটির মালিকানা হিন্দুদের দিয়ে দেয়। আর মসজিদ বানানোর জন্য অযোধ্যাতেই মুসলমানদের জন্য অন্য একটি জমি দেয়া হয়। যদিও বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে আদালত বলেছিলেন, মসজিদ ধ্বংস করাটা ছিল ‘আইনের শাসনের জঘন্য লঙ্ঘন।’
এদিকে, মসজিদের জন্য জমি বরাদ্দ দেয়া হলেও নির্মাণ কাজে কোনো গতি নেই। এমনকি ধর্মীয় এ প্রার্থনালয় নির্মাণের আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছেন না স্থানীয় মুসলিমরা।
বিতর্কিত এ স্থান নিয়ে ইতিহাস কী বলে?
মোগল আমলে ভারতবর্ষে গড়ে উঠে অসংখ্য স্থাপত্য। মোগল স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গম্বুজের ব্যবহার। সম্রাট জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর ১৫২৭ সালে অযোধ্যার নিয়ন্ত্রণ নেন তার সেনাপতি মীর বাকি। সম্রাট বাবরের নির্দেশে পরের বছর ১৫২৮ সালে সরযূ নদী পাড়ে তিন গম্বুজবিশিষ্ট এক মসজিদ নির্মাণ করেন মীর বাকি। যার নামকরণ করা হয় সম্রাট বাবরের নামের সঙ্গে মিলিয়ে। তারও সাড়ে চার শতক পরে যা ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে উঠে।
![](https://jamuna.tv/wp-content/uploads/2024/01/image-140-1024x576.png)
মসজিদের স্থান নিয়ে বিতর্কের শুরু ১৮৮৫ সালে। নির্মাণের ৩৫৭ বছর পরে। হিন্দুরা দাবি করেন, তাদের বড় অংশ বিশ্বাস করেন, শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থান ভেঙেই তৈরি হয়েছে তিন গম্বুজওলা ওই মসজিদ। মসজিদের ভেতরে থাকা একটা উঁচু বেদীর মতো অংশেই রাম ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন।
তারা এ-ও দাবি করে, মোগল আমলে একাধিকবার ওই জমি উদ্ধারের চেষ্টা হয়েছিল। যদিও সেই দাবির সমর্থনে ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ মেলেনি।
![](https://jamuna.tv/wp-content/uploads/2024/01/image-142.png)
১৯৪৭, স্বাধীনতা পায় ভারত। তার দুই বছর পর বাবরি মসজিদের ভেতরে হুট করে ‘রামলালা’র (শিশু রামচন্দ্র) মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। যা নিয়ে রহস্য রয়েই গেছে। তখন পর্যন্ত বাবরি মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন মুসলিমরা। কিন্তু রামলালার ‘আবির্ভাবকে’ কেন্দ্রে করে বিতর্ক আর সহিংসতার আশঙ্কায় আদালতের নির্দেশে সে সময় মসজিদের গেটগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়।
দীর্ঘ সময় পর ১৯৮৬ সালে মসজিদের দরজা আবার খুলে দেয়া হয়। তবে তা নিয়েও রয়েছে সমালোচনা। অনেকের মতে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের সমর্থন পেতে তখনকার ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার সেটি খুলে দেয়।
তারও চার বছর পর, অর্থাৎ ১৯৯০ সালে বাবরি মসজিদের স্থলে রামমন্দির গড়ে তোলার গণপ্রচার শুরু করে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। তারা তখনও ভারতের রাজনীতিতে ছোট রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচিত হতো। বর্তমানে দেশটিতে ক্ষমতাসীন এ দলটির যাত্রাই শুরু হয়েছিল এর ১০ বছর আগে, ’৮০ সালে। তাদের এই গণপ্রচার শুরুর ২ বছর পর উন্মত্ত হিন্দুরা ভেঙে ফেলে বাবরি মসজিদ।
বিজেপিও তাদের হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভিত্তির ওপর করে ভারতের রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান করে নেয়। তার মধ্যে ২০১৪ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি। তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অন্যতম ছিল অযোদ্ধায় রাম মন্দির নির্মাণ। যা ভারতে চব্বিশের ভোটের আগে উদ্বোধন করা হলো।
![](https://jamuna.tv/wp-content/uploads/2024/01/image-146.png)
অমিতাভ বচ্চন ও অভিষেক বচ্চনসহ বলিউডের অনেক উপস্থিত ছিলেন উদ্বোধনীতে। ছবি: আল জাজিরা।
মসজিদ ভাঙার সময়কালে নরেন্দ্র মোদি ছিলেন বিজেপির গুজরাট শাখার মাঝারি মানের নেতা। তখন সবাই তাকে লালকৃষ্ণ আদভানির বিশ্বস্ত সহচর হিসেবেই চিনতেন। পরে রাজনীতির গতিপথ তাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে।
মন্দির নির্মাণে কত খরচ হয়েছে:
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাবেক চিফ অব স্টাফ নৃপেন্দ্র মিশ্রের নেতৃত্বে গঠিত একটি প্যানেলের তত্ত্বাবধানে মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। মন্দিরের নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫ বিলিয়ন রুপি (১৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। মন্দিরটির জন্য দেশটির প্রায় ৪ কোটি মানুষের কাছ থেকে ৩০ বিলিয়ন রুপি (৩৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সংগ্রহ করা হয়।
রাম মন্দিরে নির্মাণে অর্থ দেন ভারতের জনপ্রিয় তারকারাও। অক্ষয় কুমার, অনুপম খের, হেমা মালিনী, মুকেশ খন্না, পবন কল্যাণ এবং রামের চরিত্রে অভিনয় করে টেলিভিশনে আত্মপ্রকাশ করেন অভিনেতা গুরমীত চৌধুরীসহ অনেকে বড় অঙ্কের অনুদান দিয়েছেন।
![](https://jamuna.tv/wp-content/uploads/2024/01/image-147.png)
কতটুকু জায়গায় তৈরি করা হয়েছে রাম মন্দির:
২ দশমিক ৭ একর জমিতে একটি কমপ্লেক্সের ভেতর নির্মাণ করা হয়েছে মন্দির। তবে মন্দিরের পুরো এলাকা ৭০ একর জমিজুড়ে বিস্তৃত।
রাম মন্দিরের সাথে সিরিয়ালের সম্পর্ক কী?
অনেকের মতে, ভারতে রামমন্দিরের পক্ষে জনমত তৈরিতে সিরিয়ালের বড় অবদান ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় রামায়ণের চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন, তারা এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন যে ‘সীতা’ চরিত্রে অভিনয় করা দীপিকা চিকলিয়া বা ‘রাবণে’র চরিত্রাভিনেতা অরবিন্দ ত্রিবেদীকে ১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে গুজরাটের বরোদা ও সবরকান্থা থেকে জিতিয়ে এমপি করে আনতে বিজেপির কোনও সমস্যাই হয়নি। এরপর ২০২১ সালে রাম চরিত্রের অভিনেতা অরুণ গোভিলও বিজেপিতে যোগ দেন।