আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ ইরানপন্থি হুতি যোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ্য করে ইয়েমেনে ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যসহ তার পাঁচ মিত্র। এ ‘অভিযানের’ কথা নিশ্চিত করে এর জবাবে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে হুতি বিদ্রোহীরা। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইয়েমেনে হুতিদের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুসেইন আল-ইজি বলেছেন, এ হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে চরম মূল্য দিতে হবে। ইয়েমেনের টিভি চ্যানেল আল-মাসিরাহ তাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে এ ‘নির্লজ্জ আগ্রাসনের’ জন্য ‘চরম মূল্য’ দিতে হবে। হুতি কর্মকর্তা আব্দুল কাদের আল-মোর্তাদা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক্স-এ জানিয়েছেন, ইয়েমেনজুড়ে হামলা চালানো হয়েছে। রাজধানী সানা, হুদায়দাহ গভর্নরেট, সাদা ও ধামারে বেশ কয়েকটি হামলা হয়েছে। হুতিদের লোহিত সাগর বন্দরের শক্ত ঘাঁটি হুদায়দাতে হামলা করা হয়েছে।
বার্তাসংস্থা এপি জানিয়েছে, হুতিদের ব্যবহৃত সামরিক অবস্থান লক্ষ্য করে ব্যাপক বোমা হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দুই দেশের সেনারা। এপি আরো জানিয়েছে, হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, যেগুলো জাহাজ থেকে ছোড়া হচ্ছে। এছাড়া যুদ্ধবিমানও ব্যবহার করা হয়েছে। গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসনের পর ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে সম্প্রতি যেসব হামলা চালিয়ে আসছে তার জবাবে হুতিদের লক্ষ্য করে সরাসরি হামলা চালালো দেশ দুটির সেনাবাহিনী।
হুতিদের ওপর হামলার বিষয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে লোহিত সাগরে উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে গঠিত মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটভুক্ত ১০ দেশ। এগুলো হল- অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, কানাডা, ডেনমার্ক, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিবৃতিতে হুতিদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘ব্যাপক ঐকমত্যের’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে গত মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবের কথাও বলা হয়েছে, যাতে বিদ্রোহীদের লোহিত সাগরে জাহাজে তাদের হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইয়েমেনে বহুপাক্ষিক এসব হামলা ‘একক এবং যৌথ আত্মরক্ষার অধিকার থেকেই চালানো হয়েছে। নিখুঁত এ হামলার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য এবং বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পানিপথে আন্তর্জাতিক নাবিকদের জীবন হুমকির জন্য হুতিরা যে ক্ষমতা ব্যবহার করে তা ব্যাহত এবং অবনমিত করা।” এতে বলা হয়, “আমাদের লক্ষ্য উত্তেজনা কমানো এবং লোহিত সাগরে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা।
রাজধানী সানার হুদাইদাহে লোহিত সাগর বন্দর, ধামার ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে হুতিদের শক্ত ঘাঁটিতে হামলার খবর পাওয়া গেছে। দুই মাস ধরে লোহিত সাগরে ইসরাইল সংশ্লিষ্ট ও ইসরাইলগামী জাহাজে অব্যাহতভাবে হামলা চালিয়ে আসছে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যুদ্ধজাহাজ লক্ষ্য করে ২০টি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে হুতিরা। এরপরই এ হামলার জবাব দেওয়ার হুমকি দেয় যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য। তবে হুতিদের পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া হয়- তাদের এ হামলার পাল্টা হামলার জবাব দেবে তারা। এসব টানা হামলা চালানোর পর এখন হুথিদের লক্ষ্য করে সরাসরি হামলা চালিয়েছে ব্রিটিশ ও মার্কিনি সেনারা। হামলায় হুথিদের অস্ত্র ভাণ্ডার, কমান্ড সেন্টারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো লক্ষ্য করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এক মার্কিন কর্মকর্তা।
যুদ্ধে যে নতুন মোড়ের ঘোষণা হুতি গোষ্ঠীর : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার যুদ্ধে নতুন মোড় নিয়েছে উল্লেখ করে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী জানিয়েছে, এ সংঘাত এখন ‘গণহত্যায় সমর্থনকারী ও বিরোধিতাকারীদের’ সংঘাতে রূপ নিল। ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ব্রিটেনে হামলার প্রতিক্রিয়ায় এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। শীর্ষ হুতি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল-বুখাইতি প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ইয়েমেনে হামলার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বোকামি করেছে। এজন্য তাদেরকে অনুশোচনায় ভুগতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টে আল-বুখাইতি বলেন, ‘লন্ডন এবং ওয়াশিংটন ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে বড় ভুল করল’। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব এখন একটি ‘অনন্য যুদ্ধ’ প্রত্যক্ষ করছে, যেখানে কারা ‘সঠিক এবং কারা ভুল’ কে সমর্থন করছে তা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়’। আল-বুখাইতি বলেন, ‘এ যুদ্ধে একটি পক্ষের লক্ষ্য হল- গাজায় গণহত্যার মতো অপরাধ বন্ধ করা। আর অন্য পক্ষের লক্ষ্য- অপরাধীদের সমর্থন করা এবং রক্ষা করা’। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের প্রতিটি ব্যক্তি এখন দুটি বিকল্পের মুখোমুখি। হয় গণহত্যার শিকারদের পাশে দাঁড়াবে নয়তো অপরাধীদের পক্ষ নেবে। এখানে তৃতীয় কোনো বিকল্প নেই’।
উল্লেখ্য, গাজায় ইসরাইলি হামলা বন্ধের দাবিতে লোহিত সাগরে ইসরাইল অভিমুখী ও ইসরাইলি মালিকানাধীন জাহাজে গত দুই মাস ধরে হামলা চালিয়ে আসছিল হুতিরা। এর জবাবে এ পদক্ষেপ নিল দুই পশ্চিমা পরাশক্তি।
ইয়েমেনে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ হামলার নিন্দা রাশিয়ার : ইয়েমেনে সামরিক হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া। গতকাল রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নারী মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এই নিন্দা জানান।
মারিয়া জাখারোভা সাংবাদিকদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্রদের দায়িত্বজ্ঞানহীন এমন কর্মকাণ্ডের দৃঢ় নিন্দা জানাই আমরা। তিনি আরো বলেছেন, লোহিত সাগর অঞ্চলে বড় আকারের সামরিক হামলা ইয়েমেনে শান্তি স্থাপনের ইতিবাচক পদক্ষেপকে ব্যাহত করতে পারে। এছাড়া পুরো মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত করতে উসকানি দিতে পারে। লোহিত সাগরে নৌযানে হামলার জবাবে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের অবস্থানে বিমান ও সাগর পথে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এর ফলে গাজায় ইসরাইল-হামাস সংঘাত নাটকীয়ভাবে আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইরানপন্থি হুথিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ইয়েমেনের বেশিরভাগ ভূখণ্ড।
ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ আরব দেশগুলোর অংশীদার রাশিয়া শুক্রবার এই বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি আলোচনা আহ্বান করেছে। ইরানও মার্কিন নেতৃত্বাধীন হামলার নিন্দা জানিয়ে বেআইনি হিসেবে অভিহিত করেছে।
হুথিদের এক মুখপাত্র বলেছেন, ইঙ্গ-মার্কিন হামলার কোনও ন্যায্যতা নেই এবং লোহিত সাগরে ইসরাইলগামী জাহাজে হামলা অব্যাহত থাকবে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষের বৈঠকের আহ্বান রাশিয়ার : ইয়েমেনের ভূখণ্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের বিমান হামলার বিষয়ে রাশিয়া শুক্রবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘে রাশিয়ার স্থায়ী মিশন তার টেলিগ্রাম চ্যানেলে একথা বলেছে। মিশন বলেছে, ‘ইয়েমেনে মার্কিন ও যুক্তরাজ্যের হামলার বিষয়ে রাশিয়া ১২ জানুয়ারি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকের জন্য অনুরোধ করেছে’। মিশন টিএএসএসকে জানিয়েছে যে, মিটিংটি স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় নির্ধারিত হয়েছিল।
বুধবার, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা অবিলম্বে বন্ধের দাবিতে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ইউএনএসসির ১১ জন সদস্য নথিটির পক্ষে ভোট দিয়েছেন, যেখানে রাশিয়া, চীন, আলজেরিয়া এবং মোজাম্বিক নামক চারটি দেশ বিরত ছিল। তার আগে, ইউএনএসসি খসড়া রেজুলেশনের পাঠ্য সংশোধনের জন্য তিনটি রাশিয়ান প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল, যার মধ্যে একটি ছিল যেটি লোহিত সাগরে সাম্প্রতিক বৃদ্ধির কারণ হিসাবে ফিলিস্তিন এবং ইসরাইলের মধ্যে বিরোধের কথা উল্লেখ করেছিল।
গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি-ইসরাইল বিরোধ বৃদ্ধির পর হুথিরা দাবি করেছিল যে, তারা ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামলা চালাবে এবং এর সাথে যুক্ত জাহাজগুলিকে লোহিত সাগর এবং বাব এল-মান্দেব প্রণালীর মধ্য দিয়ে যেতে দেবে না। ফিলিস্তিনি ছিটমহল অপারেশন বন্ধ, সেন্টকম অনুসারে, নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে এই পানিসীমায় ২০টিরও বেশি বাণিজ্যিক বাহক এবং জাহাজ আক্রমণ করা হয়েছে। প্রতিক্রিয়া হিসাবে, মার্কিন সরকার ঘোষণা করেছে যে, এটি লোহিত সাগরে নৌচলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং জাহাজগুলোকে রক্ষা করার জন্য অপারেশন সমৃদ্ধি গার্ডিয়ান চালু করছে। ১২ জানুয়ারির প্রথম দিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সামরিক বাহিনী ইয়েমেনের বেশ কয়েকটি শহরে হুথি অবস্থানে বিমান হামলা চালানোর জন্য ভূপৃষ্ঠের জাহাজ, যুদ্ধবিমান এবং সাবমেরিন ব্যবহার করে। সূত্র : আল-জাজিরা, সিএনএন, এপি ও রয়টার্স।