আমেরিকান মুসলিম ভোটাররা যে কারণে ডেমোক্র্যাট পার্টি থেকে সরে আসছেন

এক ঐতিহাসিক রদবদলে ডেমোক্র্যাটদের প্রতি দুই দশকের আনুগত্য থেকে বেরিয়ে এসেছেন মুসলিম ও আরব আমেরিকানরা। মঙ্গলবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও তৃতীয় দলের প্রার্থীদের ঝুলিতে তাদের অধিকাংশের ভোট পড়েছে।

গাজার যুদ্ধকে বাইডেন প্রশাসন যেভাবে পরিচালনা করেছে তা নিয়ে তৈরি হওয়া ক্ষোভ এই দলত্যাগে ইন্ধন জুগিয়েছে, এবং গুরুত্বপূর্ণ সুইং স্টেটগুলিতে ট্রাম্পকে জয়ী করতে সহায়তা করেছে। হোয়াইট হাউস দখলের লড়াইয়ে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিসকে পরাজিত করেন।

কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনস ১ হাজারের বেশি ভোটারকে নিয়ে একটি এক্সিট পোল বা বুথ ফেরত সমীক্ষা করেছিল। এই জরিপ অনুযায়ী, মুসলিম ভোটারদের অর্ধেকেরও কম হ্যারিসকে সমর্থন করেছেন। সিএআইআরের সরকার বিষয়ক পরিচালক রবার্ট ম্যাককো বলেছেন, এদের অধিকাংশই তৃতীয় দলের প্রার্থী বা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন।

ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ম্যাককো বলেছেন, “গত ২০ বছরে এই প্রথম মুসলিম সম্প্রদায় তিনটি প্রার্থীতে ভাগ হয়ে গেছে।”

সিএআইআরের বুথফেরত সমীক্ষার তথ্য বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হতে চলেছে।

মুসলিম ভোটে রদবদল

আরব আমেরিকান ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট জেমস জগবি বলেছেন, আরব আমেরিকান ভোটারদের মধ্যে মুসলিম ভোট রদবদলের প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছিল। এরা দুই দশকের বেশি সময় ধরে ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের (২ থেকে ১) সমর্থন করে এসেছিল।

জগবি ভিওএ-কে বলেন, “তারপর এই নির্বাচন এল যেখানে গাজা একটা প্রভাব ফেলেছে এবং এই সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে বিপুল পরিমাণে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল; আমি ভাবতেই পারিনি এটা এতটা প্রভাব ফেলবে। তারা গাজায় যা ঘটতে দেখেছে তা তাদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।”

যুক্তরাষ্ট্রে আনুমানিক ৩৭ লক্ষ আরব আমেরিকান রয়েছেন যাদের অধিকাংশই খ্রিস্টান এবং একই সংখ্যক মুসলিম আমেরিকানও রয়েছেন।

মিশিগানে আরবদের শক্ত ঘাঁটগুলি হল ডিয়ারবোর্ন, ডিয়ারবোর্ন হাইটস ও হ্যামট্রামাক। সেখানে ভোটারদের এই বিদ্রোহ সবচেয়ে জোরালো।

ডিয়ারবর্নের এক হুক্কা লাউঞ্জে 'ট্রাম্পের পক্ষে আরব আমেরিকান' গ্রুপের সদস্যরা টেলিভিশনে ডনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় ভাষণ দেখে উল্লাস করছেন। ফটোঃ ৬ নভেম্বর, ২০২৪।

ডিয়ারবর্নের এক হুক্কা লাউঞ্জে ‘ট্রাম্পের পক্ষে আরব আমেরিকান’ গ্রুপের সদস্যরা টেলিভিশনে ডনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় ভাষণ দেখে উল্লাস করছেন। ফটোঃ ৬ নভেম্বর, ২০২৪।

ডিয়ারবোর্নের বাসিন্দাদের ৫৫ শতাংশের বেশি মধ্যপ্রাচ্য-বংশোদ্ভূত। ট্রাম্প এখানে ৪২ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন। চার বছর আগে তিনি এই অঞ্চলে ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। হ্যারিস মাত্র ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন, অথচ এই জনগোষ্ঠী তাদের ভোটের প্রায় ৭০ শতাংশই উপুড় করে দিয়েছিল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মুসলিম সংখ্যাগুরু শহর হ্যামট্রামাকে ট্রাম্প মোট ভোটের ৪৩ শতাংশ লাভ করেছেন। তিনি ২০২০ সালে এই শহরেথেকে মাত্র ১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। হ্যারিস পেয়েছেন ৪৬ শতাংশ ভোট, যেখানে চার বছর আগে বাইডেন পেয়েছিলেন ৮৫ শতাংশ ভোট।

গ্রিন পার্টির প্রার্থী জিল স্টেইন গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধের কঠোর সমালোচক। তিনি এই দুই শহরে ২০ শতাংশের কম ভোট টানতে পেরেছেন।

ডিয়ারবোর্ন-ভিত্তিক রিয়েলটর ও রাজনৈতিক সক্রিয় কর্মী সামরা লুকমান বলেছেন, এই রদবদল “একেবারে বিস্ময়কর।”

লুকমান বলেছেন, “এটা সত্যি, সত্যিই দারুণ।” গাজা ইস্যুতে দল বদল করার আগে গত শরতে তিনি বাইডেনের হয়ে প্রচার করেছিলেন।

শেষবার মুসলিম আমেরিকানরা ঢালাও রিপাবলিকানকে ভোট দিয়েছিলেন ২০০০ সালে। সেবার জর্জ ডব্লিউ বুশ এই সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছিলেন।

পরিস্থিতিটা বদলে যায় ৯/১১-এর হামলার পর। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কিছু রক্ষণশীল মুসলিম সাংস্কৃতিক ইস্যুতে রিপাবলিকান দলের দিকে আবার ঝুঁকতে শুরু করেছেন।

লুকমান বলেন, গাজা নিয়ে ক্ষোভ দক্ষিণপন্থার দিকে এই রদবদলকে সংহত করেছে।

তিনি আরও বলেন, “এই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের কফিনে এটা সত্যিই পেরেক পুঁতে দিয়েছে।”

Mural bergambar perempuan bercadar terlukis di dinding salah satu bangunan sebagai bagian dari proyek pemerintah Kota Hamtramck. (Foto: VOA)

মিশিগানের হ্যামট্রামাক যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র মুসলিম-প্রধান শহর।

তবুও কিছু বিশেষজ্ঞ মুসলিম ভোটারদের মধ্যে হ্যারিসের দুর্বল পারফরম্যান্সকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সতর্কতার আহ্বান জানিয়েছেন। ক্রিস্টোফার নিউপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউসেফ শৌহুদ বলেছেন, এপি ভোটকাস্ট দেখিয়েছিল, ভাইস প্রেসিডেন্ট গড়পড়তা মুসলিম ভোটের ৬৩ শতাংশ দখল করেছেন যা ২০২০ সালে বাইডেনের চেয়ে সামান্য কম।

ইন্সটিউট ফর সোশ্যাল পলিসি অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এ (আইএসপিইউ) গবেষণা বিভাগের পরিচালক সাহির সিলদ যোগ করেছেন, “ডিয়ারবোর্ন ব্যতিক্রমী ঘটনা হলেও আমার মনে হয় দেশজুড়ে মুসলিম ভোটারদের প্রধান প্রবণতা কী তা বুঝতে আমাদের অপেক্ষা করে দেখা দরকার।”

গাজায় যুদ্ধ নিয়ে প্রতিশ্রুতি

তারপরেও ট্রাম্প লক্ষণীয়ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন। তিনি ২০২০ সালে মুসলিম ভোটের ৩৫ শতাংশ অর্জন করার পর চলতি বছর সক্রিয়ভাবে মুসলিম ও আরব ভোটারদের কাছে দরবার করেছেন এবং গাজার সংঘাত বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গত সপ্তাহে তিনি হ্যামট্রামাকে সফর করেন, যে শহরের মুসলিম মেয়র নির্বাচনে তাঁকে সমর্থন করেন।

“এখানে তার প্রচার দৃষ্টির অগোচরে থাকেনি,” বলেন অসম “কামাল” রহমান, একজন বাংলাদেশী আমেরিকান যিনি ২০২১ সালে মেয়র হওয়ার জন্য নির্বাচনে লড়েছিলেন। তিনি ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন।

লুকমান বলেন, ট্রাম্পের শান্তি বার্তা অনেক ভোটারকে স্পর্শ করেছে ও তাদের মধ্যে অনুরণিত হয়েছে।

লুকমান বলেছেন, “চলতি বছর তিনি বেশ কয়েকবার বলেছেন এবং এটা প্রায় একটা মডেলের মতো হয়ে উঠেছিল যে, তিনি যুদ্ধ থামাতে চান, যুদ্ধ থামাতে চান, যুদ্ধ থামাতে চান।”

মুসলিম আমেরিকানদের কাছে গাজা এক নম্বর ইস্যু হলেও রুজি-রোজগারের প্রশ্নও অনেককে হ্যারিস থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করেন বেশ কয়েকজন সমাজকর্মী ও ভোটার।

ডিয়ারবোর্নের এক তথ্য বিশ্লেষক নেগি আলমুদেগি বলেছেন, “আমি দফতরে এমন লোকজনকে চাই যারা প্রথম ও সবার আগে আমেরিকানদের ঘরোয়া সমস্যাগুলিকে সমাধান করার দিকে নজর দেবেন।”

আইএসপিইউ গ্রীষ্মে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল যাতে দেখা যায়, মুসলিম ভোটারদের কাছে অর্থনীতির ইস্যু রয়েছে তিন নম্বরে। প্রথমে রয়েছে গাজায় সংঘাত ও দ্বিতীয় স্থানে বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ বন্ধ করা।

অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অফ মুসলিম এক্সপেরিয়েন্সের যৌথ-পরিচালক চ্যাড হেইনেস বলেছেন, “অন্যদের মতো তারা এই যন্ত্রণাটা সমপরিমাণে অনুভব করছেন। তাই, আমার মনে হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের খুব নির্দিষ্ট স্বার্থ ও উদ্বেগের কথা বললে, এটাই প্রধান ইস্যু।”

হেইনেস ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়ে মুসলিম হয়েছেন। তিনি হ্যারিসকে ভোট দিয়েছেন। তার কথায়, এই নির্বাচন মুসলিম আমেরিকান জনগোষ্ঠীকে দুইভাগে ভাগ করে দিয়েছিল; একদল ডেমোক্র্যাটদের গাজার বিষয়ে একটা বার্তা দিতে চেয়েছে এবং অন্যদল ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন নিয়ে ভীত ছিল।

হেইনেস এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “সুতরাং…একটা শিবির খুশি যে…ডেমোক্র্যাটরা এক রকমভাবে ধাক্কা খেয়েছে এবং আরেক শিবির আসন্ন চার বছর নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।”

সূত্র: ভয়েস অফ আমেরিকা।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *