আজ ভয়াল সিডর দিবস; এখনো টেকসই ভেড়িবাঁধ পেলো না উপকূলবাসী

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াল স্মৃতি বিজড়িত ১৫ নভেম্বর। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল স্মরণকালের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় সিডর। সিডরের আঘাত, প্রাণহানী, ক্ষয়-ক্ষতির সেই দুঃসহ স্মৃতি যা আজো ভুলতে পারেনি স্থানীয় মানুষ।

ওইদিন উপকূলের লাখো মানুষ সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল। ঘটেছিল হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি। স্বজনহারা মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। সিডরের তান্ডবে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয় দক্ষিণাঞ্চলের ৩০ জেলার দুই শতাধিক উপজেলা। বিধ্বস্ত হয় ৬ লাখ মানুষের বসতবাড়ি, ফসলের ক্ষেত। ভয়াবহ বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সড়ক, নৌ, বিদ্যুৎ এবং টেলিযোগাযোগসহ আধুনিক সভ্যতার সার্বিক অবকাঠামো। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে প্রকৃতির এ ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র দেখে শিউরে ওঠে গোটা বিশ্ব। সাহায্যের হাত বাড়ায় দেশি-বিদেশিরা। সময়ের আবর্তনে বছর ঘুরে ঘুরে এসেছে সেই দিন। স্মৃতিচারণে চাপা কান্না আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের উদ্দেশে বহু জায়গায় আয়োজন করা হবে দোয়া ও মোনাজাতের।

তৎকালীন বরগুনার ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির উপ পরিচালক (বর্তমানে পটুয়াখালী জেলায় কর্মরত) আসাদুজ্জামান খান জানান, সেদিন রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে কোনো কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ করে শুরু হয়ে গেল ঘূর্ণিঝড়। এর আগে কয়েকদিন ধরেই বিক্ষুব্ধ ছিল প্রকৃতি। গভীর সমুদ্রে নিম্নচাপের খবর দিচ্ছিল আবহাওয়া বিভাগ। আগেরদিন বিকেলে দেয়া হয় ১০ নাম্বার মহাবিপদ সঙ্কেত। প্রশাসনের উদ্যোগে আর প্রচারণায় সাইক্লোন শেল্টারসহ বিভিন্ন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয় উপকূলের মানুষ। মোটামুটি ভালোভাবেই কাটে আগের রাতটি। ঝড় হয়নি দেখে পরদিন সকালে ঘরে ফেরে সবাই। তখনো বহাল ছিল সর্বোচ্চ বিপদ সঙ্কেত। বিকেল থেকে বাড়তে শুরু করে ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি। বিকেল ৫টা নাগাদ হিরণ পয়েন্টে থাকা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির ওয়্যারলেসের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগ। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় সমুদ্র থেকে উপকূলে উঠতে শুরু করে সিডর। সঙ্গে করে নিয়ে আসে ১২-১৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস।

প্রধানত, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোতে আঘাত হানে সিডর। সরকারি-বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী সে সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩০ জেলার ২০০ উপজেলা। অন্যান্য ঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো এবারো হতাহত আর নিখোঁজের সংখ্যা নিয়ে বৈপরিত্য দেখা দেয় সরকারি-বেসরকারি হিসেবে। সরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা বলা হয় ৩৩৬৩। অপরদিকে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার বলে জানায় রেড ক্রিসেন্ট। বরগুনাসহ উপকূলের রাস্তাঘাট, পুল-ব্রিজ, ঘরবাড়ি, গৃহস্থালি, গাছপালা, হাঁসমুরগি, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাথ সব লন্ডভন্ড করে দেয় সিডর। মানুষ অসহায়ের মতো শুধু চোখ দিয়ে দেখেছে। প্রতিরোধ করার মতো কিছুই তাদের ছিল না; -স্মৃতি চারণ করেন বরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার ও সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন মনোয়ার।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বরিশাল অঞ্চলের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দেশের উপকূল সুরক্ষায় ১২৩টি পোল্ডারের অধীনে পাউবোর পাঁচ হাজার ১০৭ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৯৫৭ কিলোমিটার হচ্ছে সমুদ্র-তীরবর্তী বাঁধ। সমুদ্রের তীরবর্তী এ বাঁধের সিংহভাগই বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলার আওতায়। সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের সিডরে উপকূলীয় অঞ্চলের দুই হাজার ৩৪১ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিলো প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ছয় জেলার প্রায় ১৮০ কিলোমিটার সম্পূর্ণ এবং এক হাজার ৪০০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, সিডরে বেড়িবাঁধ ভেঙে নোনা পানি ঢোকায় তাৎক্ষণিকভাবে চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়া জমির পরিমাণ ছিলো ১১ লাখ ৭৮৭ হেক্টর। মৃত্যু ঘটে ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৫৬০টি হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর। জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ভেসে যাওয়া এবং বিধ্বস্ত হওয়া সড়কের দৈর্ঘ্য ছিল ৮ হাজার ৭৫ কিলোমিটার। ক্ষতিগ্রস্থ হয় ১ হাজার ৬৮৭টি ব্রিজ-কালভার্ট। তাৎক্ষণিকভাবে ৪ হাজার কোটি টাকার ফসলহানির হিসের দেয় কৃষি বিভাগ।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *