‘অ আ ক খ’ বলার জন্যও স্বাধীনতা প্রয়োজন। অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা আর ঢাকার রাজপথে রক্ত দিয়েই লেখা হয়েছিল সেই স্বাধীনতার ইতিহাস, ফেব্রুয়ারির ইতিহাস। আজ ১ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের রক্তস্নাত এই মাসে মায়ের ভাষা বাংলাকে রক্ষায় ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে নেমেছিলেন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকসহ বাংলার দামাল ছেলেরা। জীবন দিয়ে বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন মাতৃভাষার মর্যাদা, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। তাদের অমলিন স্মৃতি স্মরণের মাস এই ফেব্রুয়ারি।
বাংলার এই দামাল ছেলেদের বুকের রক্ত ঢেলে লেখা ইতিহাসের মাধ্যমেই নতুন সূর্যের দেখা পায় বাংলা ভাষাভাষীরা। ভাষা আন্দোলনের সেই লড়াই থেকে সঞ্চিত শক্তিই পরবর্তীকালে যুগিয়েছে গণঅভ্যুত্থানের প্রেরণা। সেই লড়াই থেকে সঞ্চিত শক্তিই প্রেরণা দেয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে। একইসঙ্গে পরবর্তীকালে বাঙালিকে প্রেরণা দিয়েছিল একাত্তরে স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা ঘটাতেও।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও পাকিস্তান গঠনের পরপরই মূলত বাঙালির মাতৃভাষা বাংলার ওপর প্রথম আঘাত আসে। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ২১ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) এক সমাবেশে ঘোষণা দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এরপর ২৪ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে একই ঘোষণা দেন। দুই জায়গাতেই বীর ছাত্র-জনতা তার বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানান।
একই বছরের ২৭ নভেম্বর করাচিতে পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে পাকিস্তান গণপরিষদের কাছে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ও প্রাদেশিক সরকারগুলোর কাজ চালানোর মাধ্যমরূপে মেনে নেয়ার সুপারিশ করা হয়। সেইসঙ্গে গোটা পাকিস্তানে প্রাথমিক শিক্ষায় উর্দুকে এক বছরের জন্য বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তমুদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়।
দীর্ঘ চার বছর ধরে আন্দোলন চলার পর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে বাঙালি লেখে এক নতুন ইতিহাস। ওই দিন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ গেটে ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। শহীদ হন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক। তাদের স্মরণে আজ সেই ২১ ফেব্রুয়ারি একটি অভিধা, ধ্বনি ও প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
ভাষার জন্য বাংলার দামাল সন্তানদের আত্মত্যাগ স্বীকৃতি পেয়েছে আন্তর্জাতিকভাবেও। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। এরপর থেকে এ দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে দেশে দেশে পালিত হয়।
এই আন্দোলনই ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি তৈরিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখে। বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধ ভাষা আন্দোলনেরই পরিণতি। তাই ফেব্রুয়ারি মাস প্রতি বছরই অনন্য আবেদনে বাঙালিকে তার অস্তিত্বসংকটের ঐতিহাসিক যাত্রাপথকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়।