স্টাফ রিপোর্টারঃ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে খেলোয়াড়-কোচ সবাই একটা কথা বলে থাকেন- ‘ওয়ানডেতে বাংলাদেশ সবচেয়ে শক্তিশালী।’ এ নিয়ে সমর্থকদেরও মনেও সন্দেহ নেই। টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে যাইহোক, ৫০ ওভারের ক্রিকেটে যেকোনো দলকে হারিয়ে দিতে পারে বাংলাদেশ।
সেই ফরম্যাটেরই বিশ্বকাপে কী অবস্থা হলো বাংলাদেশের! ভারতের কন্ডিশন অনেকটা বাংলাদেশের মতোই, ওয়ানডে সুপার লিগে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স- তাহলে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন কেন নয়? বাস্তবে চিত্র হলো অন্যরকম। নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ কাটিয়ে (২০০৩ সালের আসর বাদ দিয়ে) যন্ত্রণায় পুড়িয়েছে কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয়।
বিশ্বকাপে সম্ভাব্য সেরা স্কোয়াড নিয়ে গিয়েও সাকিব আল হাসান ও তার দলের ভরাডুবি হয়েছে। অভিজ্ঞ ও তারুণ্যের মিশেলে সামর্থ্যের সামান্যটুকুও প্রদর্শন করতে পারেনি লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। বিশ্বকাপের মঞ্চে, চেনা কন্ডিশনেই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে নিউজিল্যান্ডের দুর্বোধ্য কন্ডিশনে কী অবস্থা হতে পারে। আঁচ করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কারণ তাসমান পাড়ের দেশে বাংলাদেশের ইতিহাস একেবারেই সুখকর নয়।
স্বাভাবিকভাবেই আশার পারদ চড়েনি। কোনোরকমে একটা সিরিজ শেষ করে আসতে পারলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যাবে, এমন ভাবনাই বেশি ছিল সমর্থকদের মধ্যে। আসলে আশা দেখার কারণও ছিল না। একেবারে তরুণ একটা দল যায় নিউজিল্যান্ড সফরে। যার নেতৃত্বে নাজমুল হোসেন শান্ত। সাকিবের অনুপস্থিতিতে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির নেতৃত্ব পাওয়া এই তরুণের কাছ থেকে প্রত্যাশা ছিল না বলেই চলে। অথচ এই শান্তই লিখলেন নতুন ইতিহাস। ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হলো শান্তর বাংলাদেশের।
আগের সব অভিজ্ঞ ক্রিকেটার বা অধিনায়ক যা করতে পারেননি, শান্ত সেটিই করে দেখিয়েছেন তুলনামূলক কম অভিজ্ঞ একটা দল নিয়ে। তার নেতৃত্বেই নিউজিল্যান্ড-জুজু কাটিয়েছে বাংলাদেশ। শান্তই দেখিয়েছেন, কিউইরা অপ্রতিরোধ্য নয়, তারাও হারতে পারে বাংলাদেশের সঙ্গে।
শান্তর বাংলাদেশ প্রথমবার ওয়ানডে জেতার কীর্তি গড়েছে নিউজিল্যান্ডে। সেই সুবাতাস থেমে যাওয়ার আগেই টি-টোয়েন্টির উৎসব ছড়িয়ে দিয়েছে। সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতেই হারিয়ে দিয়েছে কিউইদের। অর্থাৎ, গত বছরের টেস্টের পর এবার ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি- সব ফরম্যাটেই নিউজিল্যান্ডের মাটিতে জয়ের সুখস্মৃতি সঙ্গী হলো বাংলাদেশের।
বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) নেপিয়ারে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড। দুর্দান্ত বোলিংয়ে কিউইদের মাত্র ১৩৪ রানে আটকে দিয়ে সফরকারীরা পেয়েছে ৫ উইকেটের জয়। এটাই কিউই কন্ডিশনে প্রথম টি-টোয়েন্টি জয় বাংলাদেশের।
এর আগের সময়টা ছিল শুধুই হতাশার। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমবার নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টি-টোয়েন্টি খেলে বাংলাদেশ। সেবার মাত্র ৭৮ রানে অলআউট হয়েছিল সফরকারীরা। ১০ উইকেটে হারা ম্যাচটিতে অধিনায়ক ছিলেন সাকিব।
হ্যামিল্টনের ওই ম্যাচের ৭ বছর পর আবার নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টি-টোয়েন্টি খেলার সুযোগ আসে। সেবারও একই পরিণতি। ৬ উইকেটের হার। মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে শুধু ওই ম্যাচ নয় তিন ম্যাচের সিরিজের সবক’টিতে হারে বাংলাদেশ।
নিউজিল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলতে আবার অপেক্ষা দুই বছরের। ২০২১ সালে হয়েছিল তিন ম্যাচের সিরিজ। সেবারও একই ফল। একই হতাশা। মাহমুদউল্লাহ নেতৃত্বেও ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ।
২০২২ সালের সফরে আবারও নেতৃত্বে সাকিব। দ্বিতীয় দফায় অধিনায়ক হিসেবে তাসমান পাড়ের দেশে গেলেও ভাগ্য বদলাতে পারেননি এই অলরাউন্ডার। সেবার পাকিস্তান ও স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে মিলে ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলেছিল বাংলাদেশ। সাকিবের নেতৃত্বে কিউইদের বিপক্ষে তো বটেই, পাকিস্তানের বিপক্ষেও হারে। চার ম্যাচের চারটিতেই হার!
অর্থাৎ, শান্তর আগে নিউজিল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলেছে বাংলাদেশ তিন অধিনায়ক- সাকিব, মাশরাফি ও মাহমুদউল্লাহর অধীনে। তাদেরই কেউই কোনও ম্যাচ জেতাতে পারেনি। শান্ত এখানে ব্যতিক্রম। মাত্র কয়েক ম্যাচের নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা দিয়ে হারিয়ে দিলেন কিউইদের। নিউজিল্যান্ডে খেলা দশম টি-টোয়েন্টিতে এসে প্রথম জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ।
ওয়ানডেতও শান্তর বাংলাদেশের জয়জয়কার। ২০০৭ সালে প্রথমবার ওয়ানডে খেলতে নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। মোহাম্মদ আশরাফুলের নেতৃত্বে তিন ওয়ানডের সবক’টিতে হারে বাংলাদেশ।
২০১০ সালে তাসমান পাড়ে খেলতে যায় সাকিবের নেতৃত্বে। সেবারও একই পরিণতি। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ। ২০১৫ সালে বিশ্বকাপের ম্যাচেও পারেনি বাংলাদেশ। হ্যামিল্টনে কিউইদের বিপক্ষে ২৮৮ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড় করিয়েও হারতে হয় মাশরাফির দলকে। ২০১৬ সালে ওই মাশরাফির নেতৃত্বেই দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলতে নিউজিল্যান্ডে যায় বাংলাদেশ দল। সেবারও একই পরিণতি। মাশরাফির দল দাঁড়াতেই পারেনি। তিন ম্যাচের সিরিজ হোয়াইটওয়াশ হয়ে ফিরতে হয়। ২০১৯ সালে আবারও মাশরাফির নেতৃত্বে যায় বাংলাদেশ। আবারও ব্যর্থ মাশরাফি।
২০২১ সালে আবারও কিউই-অভিযান। এবার অধিনায়ক পাল্টে নেতৃত্ব যায় তামিম ইকবালের কাছে। নতুন আশা খুঁজে নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু ভাগ্য বদলায়নি। আরেকবার হতাশায় শেষ হয় নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ওয়ানডে মিশন।
আরেক দফা অধিনায়ক পাল্টে তরুণ শান্তর নেতৃত্বে এবার নিউজিল্যান্ডে যায় বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর আশা না দেখাটাই ছিল স্বাভাবিক। প্রথম দুই ওয়ানডে হেরে যাওয়ায় পূর্বসূরিদের ভাগ্য বরণের দিকেই এগোচ্ছিলেন শান্ত। তবে নেপিয়ারের শেষ ওয়ানডেতে চমক দেখিয়ে ইতিহাস গড়ে নেয় তারা। ১৮বারের ব্যর্থতা ঝেরে প্রথমবার নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ওয়ানডে জয়ের কীর্তি গড়ে শান্তর বাংলাদেশ।
আশরাফুল-সাকিব-মাশরাফি-তামিমের বাংলাদেশ যা পারেনি, সেটিই করে দেখালো শান্তর বাংলাদেশ। ওয়ানডের পর টি-টোয়েন্টিতেও গড়লো ইতিহাস। অপেক্ষা এবার সিরিজ জয়ের। পারবে না শান্তর বাংলাদেশ?