স্টাফ রিপোর্টারঃ ২০১৪, ২০১৮-এর পর ২০২৪ সালের শুরুতে আরেকটি উচ্ছ্বাসহীন নজিরবিহীন ভোটবিমুখতার জাতীয় নির্বান প্রত্যক্ষ করল বাংলাদেশ। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে রোববার অনুষ্ঠিত এ ভোটের চিত্র ছিল বিস্ময়কর। কেন্দ্রগুলোতে হতাশাজনক ভোটার উপস্থিতি ছিল দিনভর আলোচনার মূল কেন্দ্রে। কোথাও কোথাও মাইকিং করেও ভোটার আনা যায়নি। রাজধানী ঢাকাকে মনে হয়েছে এক বিরানভূমি। ভোট উৎসবের পরিবর্তে ভোট বর্জনের এক নীরব প্রতিবাদ যেন ফুটে উঠেছে সর্বত্র। সকাল ৮টায় সারা দেশে ভোট গ্রহণ শুরুর তিন ঘণ্টা পরেও ভোট দেয়ার হার কোথাও ছিল ৩ শতাংশ, কোথাও ৫ কিংবা কোথাও ৮ ভাগ। নগণ্য ভোটার উপস্থিতি ছাড়াও সারা দেশে ভোটকে কেন্দ্র করে বহু অঘটন ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা, গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ, জাল ভোট, ব্যালট বাক্সে আগুন, ব্যালট পেপার ছিনতাই, এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা, নৌকার পক্ষে প্রকাশ্যে সিল মারার ঘটনা ঘটেছে।
মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে নৌকার এক সমর্থককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম-১০ আসনে খুলশীর পাহাড়তলী ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে সংঘর্ষ চলাকালীন এক যুবককে প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। তিনি হচ্ছেন যুবলীগের ক্যাডার শামীম আজাদ (ওরফে) ব্লেড আজাদ।
আচরণবিধি লঙ্ঘন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে হুমকি দেয়ার অভিযোগে চট্টগ্রাম-১৬ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের প্রার্থিতা বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের অনিয়মসহ নানা অভিযোগে সারা দেশে নির্বাচন বর্জন করেছেন ২৮ প্রার্থী। দিনশেষে ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি বলেছে, এটি ভুয়া নির্বাচন। আর নির্বাচন কমিশন প্রথমে ২৮ শতাংশ বললেও পরে বলেছে, ভোট পড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের এ নির্বাচনে ২৯৯টি আসনে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলে। সরকারি দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করায় ভোটের আগেই টানা চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগই যে ক্ষমতায় আসছে, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। ২৮টি রাজনৈতিক দলের এক হাজার ৫৩৪ জন প্রার্থী এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে ছিলেন ৪৩৬ জন।
নির্বাচনে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে নৌকার সাথে ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকে নির্বাচন করা আওয়ামী লীগের পদধারী নেতাদের মধ্যেই। নির্বাচনের আগেই ২৬ আসনে লাঙ্গল প্রতীকের জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি গত দু’টি মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করে নির্বাচন করে এবং সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। এবারো একই পথে হেঁটেছে জাতীয় পার্টি, তবে ভোটের ফলে বিরোধী দলে এবার তারা থাকতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এবার ভোটের মাঠে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছেন। এ নির্বাচনের আগে বিএনপিকে ভেঙে কিছু প্রার্থীকে ভোটে আনার প্রচেষ্টাও ছিল; কিন্তু সেটি তেমন সফল হয়নি। তবে পদধারী কয়েকজন নেতা ‘তৃণমূল বিএনপি’ ও ‘বিএনএম’ নামের দলে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। এরাও সরকারের সাথে একধরনের সমঝোতা করে নির্বাচনে আসেন।
জাল ভোট দিতে প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে আটকে রাখার অভিযোগ
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন আসনে ভোট কেন্দ্রগুলোর বাইরে শাসকদল ও তাদের সমর্থিত লোকজনের ব্যাপক জটলা থাকলেও ভোটার উপস্থিতি ছিল একেবারেই নগণ্য। সকালের দিকে কিছু ভোটার কেন্দ্রে গেলেও দুপুর গড়ানোর আগেই একেবারে ফাঁকা হয়ে যায় ভোটকেন্দ্রগুলো। ফলে ভোটার উপস্থিতি বেশি দেখাতে বিভিন্ন কেন্দ্রে ব্যাপক জাল ভোট দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। আবার বিভিন্ন কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে পার্সেন্টেজ বাড়াতে তালা মেরে আটকে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। নির্বাচন কমিশন সুনির্দিষ্ট কিছু যানবাহন ছাড়া গণপরিবহনসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ না রাখলেও গতকাল কোনো যানবাহনই রাস্তায় নামেনি। ফলে সড়কে বিশেষ করে ভোটকেন্দ্রগুলোর আশপাশে সরকারসমর্থক কিছু লোক ছাড়া অধিকাংশ নাগরিকই বাসা থেকে বের হননি।
বাইরে জটলা ভেতরে ফাঁকা : সরেজমিন দেখা যায়, ১০টি ভোটকেন্দ্রে মোট ভোটার ২৭ হাজার ৫৩৮ জন। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৪ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর এসব কেন্দ্রে ভোট পড়ে ২ হাজার ৮৫৮টি, যা শতকরা হিসাবে ১০.৪ শতাংশের কাছাকাছি। এসব কেন্দ্রে পরের এক ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ : হাতেগোনা ক’জন ভোটারের উপস্থিতি চোখে পড়ে। সকাল ৮টায় ভোট শুরু হওয়ার পর অধিকাংশ ভোটকেন্দ্র ছিল ভোটারশূন্য। এ সময় ভোট কক্ষে দায়িত্বরতদের খোশগল্পে সময় কাটাতে দেখা যায়। সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের এমন কোনো নেতাকর্মী নেই যারা মানুষকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করেননি। কিন্তু কার্যত আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাড়া কেউ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। ফলে সরকারের জনসমর্থন যে কী পরিমাণ তলানিতে নেমেছে তা এই ভোটের অঙ্কে প্রমাণিত বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।
ইতঃপূর্বে স্বাভাবিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলোতে ফজরের নামাজের পর পরই মানুষ ভোট দেয়ার জন্য নিজ নিজ কেন্দ্রে লাইনে দাঁড়িয়ে যেত; কিন্তু এবার সেই চিত্র একেবারেই ছিল অনুপস্থিত। বরং ভোট শুরুর সময়ের দিকে কেন্দ্রগুলো একেবারেই ছিল ফাঁকা। কেন্দ্রের সামনে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অধিকাংশই ভোটার নয়। সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের গ্রুপ কেন্দ্র পরিদর্শনে এলে তারা লাইনে দাঁড়িয়ে যায়, পরে আবার সরে যেতে দেখা যায়।
সকাল সাড়ে ৮টায় বহদ্দরহাট এলাকার এখলাসুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের বাইরে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৪০ থেকে ৫০ জন। এদের কেউ কেউ কিশোর। কেন্দ্রে ঢুকে দেখা যায় পাঁচজন ভোটার বুথের মধ্যে ভোট দিচ্ছেন।
একই পরিস্থিতি দেখা যায়, বাকলিয়ার শহীদ এন এম জে ডিগ্রি কলেজে। সকাল সাড়ে ৮টায় পুরো কেন্দ্রে ভোটার এসেছে মাত্র পাঁচজন। জনবহুল এলাকা খ্যাত ওই কেন্দ্রের বাইরে ১৫/১৬ জন দাঁড়িয়ে শীতের সকালে রোদের তাপ নিতে দেখা যায়। চট্টগ্রাম ১০ আসনের নিউ টাইগারপাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকাল সাড়ে ১০টায় গিয়ে জানা গেল ১১ শতাংশ ভোট সংগ্রহ হয়েছে। কেন্দ্রের দায়িত্বরত কর্মকর্তা সুমিত কুমার দত্ত জানালেন, সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ভোটারের ফ্লো ছিল। তবে দায়িত্বরত আনসার ও পুলিশ সদস্যরা বলেছেন ভিন্ন কথা। তারা বলেছেন, ওই সময়ে ঠাণ্ডার জন্য লোকজন তেমন ভোট দিতে আসেনি। বেলা বাড়লে ভোটার বাড়বে।
কাছাকাছি আরেকটি কেন্দ্র পাহাড়তলী রেলওয়ে স্কুল। সেখানের প্রিজাইডিং অফিসার উত্তম দত্ত বললেন, তাদেরও দুই ঘণ্টায় ১১ শতাংশ ভোট সংগ্রহ হয়েছে। সেখানেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন; কেন্দ্রের বাইরে লোকে লোকারণ্য, তবে কেন্দ্রের অভ্যন্তরে ফাঁকা। তিন হাজার ৩২২ ভোট-সমৃদ্ধ কেন্দ্রটিতে ওই দুই ঘণ্টায় ৩০ জনের বেশি ভোটার আসেনি বলে জানালেন প্রার্থীদের লোকজন।
পাহাড়তলী রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনি নির্বাচন কেন্দ্রে দুপুর ১২টায় গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন ভোটার রয়েছে। বাইরে থাকা লোকজন ভোটার আসার সাথে সাথে কেন্দ্রের ভেতরে নিয়ে গিয়ে পোলিং এজেন্টদের সামনে পছন্দের প্রার্থীদের ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ফেলে দিচ্ছেন। ওই কেন্দ্রে পুলিশ ও প্রিজাইডিং অফিসারসহ দায়িত্বরতরা ছিল নিশ্চুপ। প্রিজাইডিং অফিসার রানা দাশগুপ্ত জানালেন, দুই ঘণ্টায় তাদের ৩৩৩টি ভোট সংগ্রহ হয়েছে।
পাহাড়তলী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন এক দৃশ্য। ৫০/৬০ জন যুবক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ পুলিশের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। পরে জানতে পারলাম স্থানীয় এক কাউন্সিলরের অনুসারী তারা। কেন্দ্রটি দখল করে নিজেরাই ভোট বাক্সে ঢুকাচ্ছেন। এর একটু পরে দু’পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। দুপুরে সংঘর্ষ থামার পর খবর নিয়ে জানা গেছে, ভোটাররা ভয়ে কেন্দ্রের কাছে যাননি।
কাজিরদেউরী সরকারি প্রাথমিক বালক বিদ্যালয় কেন্দ্রে তিন হাজার ৩৩০ ভোটারের মধ্যে বেলা ১১টা পর্যন্ত ১৩১টি ভোট পড়ে।
বেলা সোয়া ১১টার দিকে ডা: খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পুরুষ কেন্দ্রে এক হাজার ৯৫৬ ভোটের মধ্যে ৯০টি ভোট পড়ে এবং মহিলা কেন্দ্রে দুই হাজার ১৯ ভোটের মধ্যে ৬৩টি ভোট পড়েছে বলে জানা গেছে।
দুপুর ১২টার দিকে কাপাসগোলা বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের কয়েক শ’ নেতাকর্মী বাইরে ভিড় করছেন। কিন্তু ভোটকেন্দ্র একেবারেই ফাঁকা। দায়িত্বরত প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসাইন জানালেন দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৫৯৮টি ভোট পড়ার তথ্য। এই কেন্দ্রের মোট ভোটার তিন হাজার ২২৭। কাতালগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা অমিত চৌধুরী জানান, দুই হাজার ৯৬২ জন ভোটারের মধ্যে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোট দিয়েছেন ৩২০ জন।
জামাল খান সলিমা সিরাজ মহিলা মাদরাসা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন পুলিশ ও আনসার সদস্য বসে আছেন আর ভোট কক্ষে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারা অলস বসে আছেন। কিন্তু কেন্দ্রের বাইরে যথারীতি শাসকদলের নেতাকর্মীদের ভিড়। এই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নাসির আহমেদ জানিয়েছেন দিন হাজার ৭২৫ ভোটের মধ্যে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩৪৯টি ভোট পড়েছে।
বেলা সোয়া ১টার দিকে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দু’টি কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, দুপুরা ১২টা পর্যন্ত দুই হাজার ৮২৬ ভোটের মধ্যে ৩৭৪টি ভোট পড়েছে। ২ নম্বর কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, দুই হাজার ৮৯১ জন ভোটারের মধ্যে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৫০৬ জন ভোট দিয়েছেন।
এ দিকে বিকেলের দিকে কিছুটা ভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হয়। বাইরে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাদের মধ্য থেকে থেমে থেমে বিভিন্ন জনের নামে স্লিপ দিয়ে কেন্দ্রে ভোট দিতে পাঠানো হয়। তাদের শিখিয়ে দিতে শোনা যায়- ‘শুধু নাম আর বাপের নাম মুখস্থ করলে হবে, মায়ের নাম বললে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা’। বিভিন্ন কেন্দ্রে দায়িত্বরতদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, পার্সেন্টেজ বাড়াতে শেষ দিকে এসে বেশ কিছু জাল ভোট হয়েছে এমনকি কোনো কোনো কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে তালাবদ্ধ করে রেখে ভোটের পার্সেন্টেজ বাড়িয়ে নেয়ার তথ্যও মিলেছে।
পটিয়া-চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ভোটার উপস্থিতি কমসহ বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী-১৬, ১৪, ১৫, ১২, ১৩ ও চট্টগ্রাম ৮ আসনে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। কয়েকটি ভোটকেন্দ্র এলাকায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, গুলিবর্ষণ ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে। ভোটকেন্দ্রের বাইরে সংঘটিত এসব ঘটনায় চট্টগ্রাম বাঁশখালী-১৬ আসনে সরকারদলীয় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী এমপি, চট্টগ্রাম ১৪ আসন চন্দনাইশে অ্যাডভোকেট খোরশেদ বিন ইসহাক, চট্টগ্রাম-৮ আসন বোয়ালখালীতে সুরেশ চৌধুরীসহ তিনজনের মাথা ফেটে যায়। এর মধ্যে বিকেলে নির্বাচন কমিশনে চট্টগ্রাম-১৬ আসনের নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান নৌকার প্রার্থিতা বাতিল করে।
এছাড়া চট্টগ্রাম-১৪ চন্দনাইশ এলাকায় ভোটকেন্দ্রের বাইরে পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর ও অপর একটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও গুলি বর্ষণের ঘটনায় মো: আমিন (২৭) ওয়াকিল (২৪) নামে দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
বেলা ১টায় চট্টগ্রামের বাঁশখালী উত্তর সরল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে বাঁশখালী ১৬ আসনের বর্তমান এমপি ও নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথে বিপরীত প্রার্থী সমর্থকদের পাটকেল নিক্ষেপে তার মাথা ফেটে যায়।
এ দিকে সকাল ৯টায় চট্টগ্রাম-১৪ চন্দনাইশ-হাশিমপুর এলাকায় ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথে ঘটনায় হাশিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খোরশেদ বিন এসহাকের মাথা ফেটে যায়।
দিনাজপুরে ভোটের আগেই রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর নেয়ার অভিযোগ
দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরে ভোটকেন্দ্রের ভেতর সুনসান নীরবতায় শেষ হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। কেন্দ্রের বাইরে সারা দিন ছিল উপচে পড়া ভিড়। আর ভেতরে ভোট পড়েছে খুব কম। এ ছাড়া বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার মধ্যে ছিল বিরামপুর উপজেলায় ভোট শেষের আগেই রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর নেয়ার অভিযোগ।ৎ
দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করে দেখা গেছে, দিনাজপুর সদর-৩ আসনে ১৩০টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির (নৌকা) শত শত ব্যাজধারী কর্মী-সমর্থক কেন্দ্রগুলো ঘিরে রাখে। একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী বিশ্বজিৎ ঘোষ কাঞ্চন (ট্রাক), জেলা যুবলীগের সভাপতি রাশেদ পারভেজ (ঈগল) ও জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আহমেদ শফি রুবেল (লাঙ্গল) এর কর্মী-সমর্থক ছিল সামান্য। সদর আসনে সাতজন প্রার্থী থাকলেও প্রতিটি কেন্দ্রে মোটামুটি উল্লিখিত চারজন প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট দেখা যায়। তবে কোনো কোনো কেন্দ্রে শুধু নৌকার এজেন্ট ছাড়া কাউকেই দেখা যায়নি।
এ দিকে গতকাল দুপুর ১২টায় দিনাজপুর-৬ (বিরামপুর-হাকিমপুর-নবাবগঞ্জ-ঘোড়াঘাট) আসনের বিরামপুরে মুকুন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নির্বাচন শেষ হওয়ার আগেই কেন্দ্রের ফলাফল সিটে প্রার্থীর এজেন্টদের সই নেয়া হয়। পরে ওই ফলাফল শিট ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাহিদ ইমরুল মোজাকিনের উপস্থিতিতে উপজেলা নির্বাচন কমিশনার খন্দকার মোহাম্মদ আলী ফলাফল শিট ছিঁড়ে ফেলেন।
ওই কেন্দ্রের নৌকা প্রতীকের এজেন্ট জোবায়ের হোসেন বলেন, ‘দুপুর ১২টার দিকে আমাকে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার হাজিরা দেয়ার কথা বলে সই নিয়েছেন।’
ট্রাক প্রতীকের এজেন্ট মইনুল ইসলাম বলেন, ‘কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিজাইডিং অফিসার খাইরুল আলম আমাকে বেশ কিছু কাগজ দিয়ে সই দিতে বললে আমি সই দিয়েছি। তবে কাগজগুলো কোন কাজের আমি জানি না।’
এ বিষয়ে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্বে থাকা বিরামপুর সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর খাইরুল আলম বলেন, ‘নির্বাচন শেষে হলে গ্যানজাম হয়। তাই কাজ আগানোর জন্য এজেন্টদের আগেই সই নিয়েছি।’
নির্বাচন শেষ হওয়ার আগেই আপনি সই নিলেন কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টি ওভাবে ভাবিনি।’
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা খন্দকার মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ভোট গণনার আগেই ফলাফল সিটে পোলিং এজেন্টদের সই পেয়েছি। ফলাফল শিটগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। নতুন শিট সরবরাহ করা হয়েছে।’
কুমিল্লায় ব্যালটে নৌকার সিল, সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা প্রত্যাহার
কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) উপজেলায় নৌকার প্রতীকে জোর করে সিল মারার অভিযোগ উঠলে গুনাইঘর ইউনিয়নের পদ্মকুট গ্রামের পদ্ম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের এক সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা রেহানা বেগমকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা আব্দুর রব। সিল মারা ওই ব্যালট বই এবং অভিযোগ ওঠা ব্যালট বাক্সটিও সরানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
বরিশালে ব্যালটে একতরফা সিল
বরিশাল ব্যুরো জানায়, সকাল থেকে বরিশাল নগরী ও সদর উপজেলার কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে ভোটারদের তেমন কোনো উপস্থিতি নেই। কেন্দ্রের আশপাশে শুধু নৌকার কর্মীদের আনাগোনা। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন ভোটারের।
বেলা ১১টায় জাগুয়া ইউনিয়নের চন্ডিপুর মোহাম্মদ আলী বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ভোটারদের হাতে কালি লাগিয়ে তাদের বের করে একতরফা ব্যালটে সিল মারছেন নৌকার কর্মীরা। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারদের অসহায় অবস্থায় বসে থাকতে দেখা গেছে। যদিও পুলিশ আসলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। কিন্তু পুলিশ চলে গেলে আবার একই অবস্থায় ভোট চলতে থাকে।
এই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো: রেজাউল করিম খান জানালেন- এই কেন্দ্রে ভোটার ২৪০০। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোট কাস্ট হয়েছে ২৯৫টি। এই কেন্দ্রের ষাটোর্ধ্ব ভোটার মমতাজ বেগম বলেন, ‘ভোট দেতে গ্যাছেলাম, মোর আতে কালি লাগাইয়া কয় ভোট অইয়া গেছে। সিল নৌকার লোকেরাই মারছে, মুই কিন্তু মনমতো ভোট দিতে পারলাম না।’
ভোটের আগেই ব্যালটে সিল, বেলাবোর এক কেন্দ্রে ভোট বাতিল
নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, নরসিংদী-৪ (বেলাব-মনোহরদী) আসনে অনিয়মের অভিযোগে বেলাবো উপজেলার সল্লাবাদ ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ব্যালটের ১২টি বইয়ে আগে থেকেই নৌকা প্রতীকের মাঝে সিল দেয়া ছিল। এটি দেখতে পেয়ে এই কেন্দ্রের ভোট বাতিল করা হয়েছে এবং কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
জানা গেছে, শিল্পমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের ছেলে মঞ্জুরুল মজিদ মাহমুদ সাদী জোর করে ১২টি বইয়ে নৌকার সিল মারেন। সেটি দেখতে পেয়ে লোকজন বিক্ষুব্ধ হয় ও প্রশাসনকে জানায়। পরে প্রশাসনের লোকজন এসে ঘটনার সত্যতা পায় এবং এ কেন্দ্রের ভোট ও কেন্দ্র বাতিল করে দেয়।
এ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ছিলেন, পাটুলি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুন অর রশিদ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ইউএনও অফিসে নিয়ে যায়। এ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শিল্পমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তার বিপরীতে শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন পাঁচবারের উপজেলা চেয়ারম্যান ও নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম খান বীরু।